নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি আসনের মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ আসন হিসেবে বিবেচিত হয় নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন। রাজধানী ঢাকার পাশ্ববর্তী এই আসনটি অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পকারখানায় সমৃদ্ধ এলাকা হিসেবে সবসময়ই রাজনৈতিকভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এবারও এই আসন নিয়ে তীব্র আলোচনা চলছে।
সোমবার (৩ নভেম্বর) বিএনপি দেশের ২৩৭টি আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে। তবে নারায়ণগঞ্জের ৫টি আসনের মধ্যে ৪টিতে প্রার্থী ঘোষণা করলেও বাদ রেখেছে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনটি। এ সিদ্ধান্তের পর থেকেই রাজনীতির অঙ্গনে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, বিএনপি শরীক দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের প্রার্থী মুফতি মনির হোসেন কাশেমীর জন্যই আসনটি খালি রাখা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি যদি শরীক দলকে সমর্থন দেয়, তবে মুফতি মনির হোসেন কাশেমীর মনোনয়ন প্রায় নিশ্চিত। তিনি দীর্ঘদিন ধরে নারায়ণগঞ্জের ইসলামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং বিএনপির শরীক জোটের সক্রিয় অংশ হিসেবে পরিচিত।
তবে বিএনপির ভেতরেই এই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে একাধিক নেতার নাম আলোচনায় রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন ফতুল্লা থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শাহ্ আলম, সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাশুকুল ইসলাম রাজিব, জেলা যুবদলের আহ্বায়ক সাদেকুর রহমান সাদেক, সদস্য সচিব মশিউর রহমান রনি, ফতুল্লা থানা বিএনপির সভাপতি শহীদুল ইসলাম টিটু, সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আব্দুল বারী ভূঁইয়া এবং কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট শরিফুল ইসলাম মোল্লা।
মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে মোহাম্মদ শাহ্ আলমের নাম প্রথম সারিতে রয়েছে। তিনি ফতুল্লা থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিলেন। স্থানীয়ভাবে তার রয়েছে বিশাল কর্মী-সমর্থক ভিত্তি। এর আগেও তিনি বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে নির্বাচন করেছেন। তার পরিষ্কার ভাবমূর্তি ও সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে দলীয় নেতাকর্মীদের একটি অংশ তাকে মনোনয়নের যোগ্য প্রার্থী হিসেবে দেখছেন।
অন্যদিকে সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিনও এই আসনে হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে পরিচিত। তিনি বিএনপির এক সময়ের সক্রিয় সংসদ সদস্য ছিলেন। যদিও তিনি এক পর্যায়ে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসন থেকেও প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, তবু নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনেও তার একটি বড় কর্মী-সমর্থক দল রয়েছে। স্থানীয় রাজনীতিতে তার অভিজ্ঞতা ও জনপ্রিয়তা তাকে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় শক্ত অবস্থানে রেখেছে।
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাশুকুল ইসলাম রাজিব তরুণ নেতৃত্বের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। তিনি মাঠপর্যায়ে সক্রিয় এবং তরুণদের মধ্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। সংগঠনের সংকটকালীন সময়েও তিনি জেলা কমিটিকে সক্রিয় রাখায় ভূমিকা রেখেছেন। স্থানীয় রাজনীতিতে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে বলে নেতাকর্মীরা মনে করেন।
জেলা যুবদলের আহ্বায়ক সাদেকুর রহমান সাদেক ও সদস্য সচিব মশিউর রহমান রনি – এ দুজন তরুণ নেতাও প্রার্থী হওয়ার আশায় রয়েছেন। তারা সংগঠনের নেতৃত্বে থেকে নিয়মিতভাবে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। তাদের নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জে যুবদলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নতুন গতিপ্রাপ্ত হয়েছে। ফলে তরুণ ভোটারদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ফতুল্লা থানা বিএনপির বর্তমান সভাপতি শহীদুল ইসলাম টিটু এবং সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আব্দুল বারী ভূঁইয়াও সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন। স্থানীয় রাজনীতিতে তারা দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় এবং দলীয় কার্যক্রমে নিরবচ্ছিন্নভাবে অংশ নিচ্ছেন। থানা পর্যায়ে দলের ভিত্তি মজবুত রাখতে তারা ভূমিকা রাখছেন বলে সংগঠনের অভ্যন্তরে স্বীকৃতি রয়েছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট শরিফুল ইসলাম মোল্লাও প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তিনি ছাত্রদল থেকে রাজনীতিতে উঠে এসেছেন এবং বর্তমানে কেন্দ্রীয় কৃষক দলের নেতৃত্বে রয়েছেন। মাঠপর্যায়ে তার সংগঠক হিসেবে খ্যাতি রয়েছে এবং কৃষক সমাজের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক দলীয়ভাবে তাকে একটি আলাদা অবস্থানে রেখেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন সবসময়ই নির্বাচনের মাঠে হটস্পট হিসেবে বিবেচিত হয়। কারণ এই আসনে ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জের বেশিরভাগ শিল্পাঞ্চল এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা অন্তর্ভুক্ত। এখানে ভোটারদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রতিটি নির্বাচনে দলগুলোর জন্য এ আসনটি গুরুত্ব বহন করে।
বিএনপি এবারও আসনটি নিয়ে বিশেষ কৌশল অবলম্বন করছে বলে মনে করা হচ্ছে। শরীক দলের সঙ্গে আসন সমঝোতা বা প্রার্থী চূড়ান্ত করার আগে দলটি স্থানীয় রাজনৈতিক অবস্থান ও জনসমর্থনের হিসাব-নিকাশ করছে। ফলে এখনো নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপির চূড়ান্ত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়নি।
তবে দলীয় সূত্রগুলো বলছে, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই আসনে শরীক দলের প্রার্থী দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু স্থানীয় নেতারা এখনো আশা ছাড়ছেন না। তারা মনে করছেন, শেষ পর্যন্ত বিএনপি হয়তো তাদের মধ্য থেকেই কাউকে মনোনয়ন দেবে।
সবমিলিয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী নিয়ে চলছে জোর আলোচনা ও বিশ্লেষণ। এই আসনে কারা চূড়ান্ত মনোনয়ন পাবেন- এ নিয়ে এখনো চূড়ান্ত কিছু না জানা গেলেও স্থানীয় রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। দলের ভেতর ও শরীক দলের মধ্যে সমন্বয় কতটা সফল হয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।